লাইলাতুল কদরঃ ভূমিকা
লাইলাতুল কদরের বিধান অবতীর্ণ হয়েছে মদিনা শরিফে। কেননা সুরায়ে কদর মদিনা শরিফেই অবতীর্ণ হয়েছে। এটি বছরের মূল্যবান রাত। কিছু রাত-দিন আছে, যা নবীর জন্য মূল্যবান। আবার কিছু রাত-দিন আছে, যা আমাদের জন্য মূল্যবান। নবী করিম (সা.)-এর ক্ষেত্রে মূল্যবান রাত হলো : ১. তাঁর জন্মের রাত, ২. মেরাজের রাত, ৩. হিজরতের রাত। আর তাঁর ক্ষেত্রে মূল্যবান দিন হলো : ১. তাঁর জন্মের দিন, ২. নবুয়তের দিন, ৩. তার মৃত্যুর দিন। তাই এসব দিন-রাতে আমাদের জন্য কোনো ইবাদত নেই। আর উম্মতের ক্ষেত্রে মূল্যবান রাত হলো : ১. লাইলাতুল কদর, ২. আরাফার রাত, ৩. জুমার রাত, ৪. শবেবরাত, ৫. রমজানের রাত, ৬. জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাত, ৭. ঈদুল ফিতরের রাত, ৮. ঈদুল আজহার রাত, ৯. রজব মাসের প্রথম রাত। আর উম্মতের জন্য মূল্যবান দিন হলো : ১. আরাফার দিন, ২. আশুরার দিন, ৩. শবেবরাতের দিন, ৪. জুমার দিন, ৫. রমজানের দিনগুলো, ৬. ঈদুল ফিতরের দিন, ৭. ঈদুল আজহার দিন, ৮. আইয়ামে বিজ (প্রতি মাসের চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ)। ৯. জিলহজের প্রথম আট দিন, ১০. শাওয়ালের ছয় রোজার দিন।
কিন্তু ফজিলতপূর্ণ যত রাত আছে, তার মধ্যে সেরা রাত হলো লাইলাতুল কদর বা কদরের রজনী।
লাইলাতুল কদরের পরিচিতি
কদরের রজনীর পরিচিতি মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিজেই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এটা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। আর মহিমান্বিত রজনী সম্পর্কে তুমি কী জানো? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ওই রাত্রিতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাইল) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজের জন্য তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এই রাত ফজরের উদয় পর্যন্ত।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৫)
লাইলাতুল কদর কোন তারিখে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিস
সাধারণত কদর রজনী শেষ দশকে হওয়াই বিশুদ্ধ অভিমত। হজরত আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু সায়িদকে জিজ্ঞেস করেছি, সে আমার বন্ধু ছিল। তিনি বলেন, আমরা নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে রমজানের মধ্য ১০ দিন ইতিকাফে ছিলাম। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হন এবং আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে বলেন, আমাকে কদরের রজনী দেখানো হয়েছিল, অতঃপর ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তোমরা তা শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো। আমি নিজেকে মাটি ও পানিতে সিজদা করতে দেখেছি। তাই যারা রাসুলের সঙ্গে ইতিকাফে ছিল, তারা যেন ফিরে আসে। তখন আমরা ফিরে এসেছি। আমরা আকাশে কোনো মেঘ দেখিনি। হঠাৎ একরাতে মেঘ এলো, বৃষ্টি হলো, মসজিদের ছাদ ভেসে গেল। তা ছিল খেজুরগাছের ঢালের এবং নামাজ শুরু হলো, তখন আমি রাসুল (সা.)-কে দেখেছি, তিনি পানি ও মাটিতে সিজদা করছেন। এমনকি তাঁর কপালে মাটির চিহ্ন ছিল।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৬)
আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, শেষ দশকের বিজোড় রাতের মধ্যে শেষের দিকের কয়েকটি রাতে শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
সহিহ বুখারির অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘হজরত উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) আমাদের কদরের রজনীর খবর দেওয়ার জন্য বের হয়েছেন। তখন দুজন মুসলিম পরস্পর ঝগড়া করে। তিনি বলেন, আমি বের হলাম তোমাদের কদরের রজনীর খবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়া করে, অতঃপর তা তুলে নেওয়া হয়েছে। তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ থাকতে পারে। তাই তোমরা শেষের পঞ্চম, সপ্তম ও নবম তারিখে তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৩)
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবাদের একদলকে শেষের সাত দিনে কদরের রজনী স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। তখন রাসুল (সা.) বললেন, আমি তো দেখছি তোমাদের দেখা স্বপ্ন শেষের সাত দিনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তাই যে ব্যক্তি তা তালাশ করবে, সে যেন শেষের সাত দিনেই তা তালাশ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৫)
প্রশ্ন হলো, প্রতিবছর লাইলাতুল কদর কি একই তারিখে হয়? এর জবাব হলো—ইমাম মালেক, আহমদ, সুফিয়ান সাওরি, ইসহাক ও আবু সাওর (রহ.) বলেন, লাইলাতুল কদর শেষ দশকে পরিবর্তন হতে থাকে।
তবে ইমাম আবু হানিফা, সাহেবাইন, ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মতে তা নির্দিষ্ট তারিখে হয়, পরিবর্তন হয় না। সাধারণত ইমাম শাফেয়ি লাইলাতুল কদর ২১ তারিখে হওয়ার কথা বলেছেন। আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, তা ২৭ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
বিভিন্ন দেশে ২৭ তারিখকে লাইলাতুল কদর হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর বিভিন্ন কারণ আছে।
১. ইমাম মুসলিম (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত জির (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে বলতে শুনেছি, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি পুরো বছর রাত্রি জাগরণ করবে, সে কদরের রজনী পেয়ে যাবে। তখন উবাই (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তা রমজানে। তিনি কসম খেয়ে বলতেন, আল্লাহর কসম! আমি জানি, তা কোন রাত। তা ওই রাত, যার ব্যাপারে রাসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন রাত্রি জাগরণের জন্য। আর তা হলো ২৭ তারিখের রাত। এর নিদর্শন হলো, সেদিন সূর্য উদয় হবে কিরণবিহীন। (মুসলিম, হাদিস : ৭৬২)
২. সুরা কদরে শব্দ রয়েছে ৩০টি। সেখানে রয়েছে ‘হিয়া’ শব্দ, যা দ্বারা লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে। ওই শব্দটি রয়েছে ২৭ নম্বরে।
৩. তাফসিরে কবিরে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘প্রিয় গণনা আল্লাহর কাছে বিজোড়। আর বিজোড়ের মধ্যে প্রিয় হলো সাত। তাই তিনি আসমান সাতটি বানিয়েছেন, জমিন সাতটি বানিয়েছেন, আর সপ্তাহে সাত দিন দিয়েছেন। জাহান্নামের স্তর সাতটি। তাওয়াফের চক্কর সাতটি, সিজদায় সাত অংশ ব্যবহার করা হয়, তাই লাইলাতুল কদর ২৭ তারিখ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’ (তাফসিরে কবির, খণ্ড ৩২, পৃষ্ঠা ২৩০)
৪. সুরা কদরে লাইলাতুল কদর শব্দ তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। আর তাতে অক্ষর রয়েছে ৯টি করে। তাই মোট অক্ষর ২৭ হয়।
৫. ইবনে আবি শায়বা বর্ণনা করেন, হজরত কানান ইবনে আবদুল্লাহ নাহমি থেকে বর্ণিত, আমি জির (রা.)-কে কদর রজনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি? তিনি বলেন, ওমর, হুজাইফা ও অনেক সাহাবির মতে ২৭ তারিখ। তাঁরা তাতে সন্দেহ করতেন না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৭৫৮)
৬. ইমাম তিরমিজি (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আবু জর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে রোজা রেখেছি। তিনি আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়েননি। যখন সাত দিন অবশিষ্ট রইল, তখন তিনি আমাদের সঙ্গে তারাবির নামাজ দ্বারা রাত্রি জাগরণ করেন। রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। অতঃপর তিনি আর আমাদের সঙ্গে ষষ্ঠ দিন বাকি থাকা অবস্থায় রাত্রি জাগরণ করলেন না এবং আমাদের সঙ্গে পঞ্চম দিন তথা ২৩ রমজান রাত্রি জাগরণ করলেন ও তারাবি জামাতে আদায়ের মাধ্যমে রাতের অর্ধেক অতিবাহিত করেছিলেন। আমরা তাঁকে বললাম, যদি বাকি রাতও নফল হিসেবে আমাদের সঙ্গে কাটাতেন? তখন তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে রাত্রি জাগরণ করে, শেষ পর্যন্ত তাকে সারা রাত জাগরণের পুণ্য দেওয়া হবে। অতঃপর তিনি আমাদের সঙ্গে রাত্রি জাগরণ করেননি, মাত্র তিন দিন অবশিষ্ট রইল এবং আমাদের সঙ্গে তৃতীয় দিন (২৭ তারিখে) জামাতে নামাজ পড়লেন এবং তার পরিবারকেও জাগ্রত করলেন। এমনকি আমরা সাহরি খাওয়ার সময় চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলাম। আমরা বলার পর তিনি সাহরি সমাপ্ত করেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮০৬)
সারকথা হলো, লাইলাতুল কদর শেষ দশকেই বিদ্যমান। আর তা ২৭ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আল্লাহ তা আমাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যাতে মানুষ তা তালাশের জন্য চেষ্টা করে চেষ্টারও সওয়াব পায়। আর মানুষ যেন শুধু একটি রাতের ইবাদত না করে। কদরের রজনী বছরের সেরা রজনী। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, ওই রাতের মূল্যায়ন করা।
জিকির ও দোয়া :
হাদিসে যে দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে অর্থ বুঝে বার বার পড়া যেতে পারে। ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তেগফার ও ১০০ বার দরুদ পড়া যেতে পারে। হযরত আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা: কে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ- যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে কি দোয়া করব?
জবাবে নবী সা: বলেন, এ দোয়া পড়বে- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” অর্থাৎ ‘আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করণেওয়ালা এবং বড়ই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেয়াই তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি আমাদেরা গুনাহগুলো ক্ষমা করে দাও।’
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪ রাকয়াত নামাজ কদরের রাতে আদায় করবে এবং উক্ত নামাজের প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠ করবে, আল্লাহ তা'য়ালা ওই ব্যক্তিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ করে দেবেন এবং বেহেশতের মধ্যে এক মনোমুগ্ধকর মহল তৈরি করে দেবেন।’
অপর এক হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হযরত রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কদরের রজনীতে ৪ রাকয়াত নামাজ আদায় করবে এবং উহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ক্বদর ও সূরা ইখলাছ তিনবার করে পাঠ করবে, নামাজ শেষে সিজদায় গিয়ে নিম্নের দোয়াটি কিছু সময় পাঠ করে আল্লাহর দরবারে যা-ই প্রার্থনা করবে তিনি তাই কবুল করবেন এবং তার প্রতি অসংখ্য রহমত বর্ষিত করবেন।’
দোয়াটি হলো : “সুবাহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার”
শবে কদরের নামাজ পড়ার নিয়মঃ
নফল নামাজ : ন্যূনতম বার রাকাত থেকে যত সম্ভব পড়া যেতে পারে। এ জন্য সাধারণত সুন্নতের নিয়মে ‘দুই রাকাত নফল পড়ছি’ এ নিয়তে নামাজ শুরু করে শেষ করতে হবে।
এ জন্য সূরা ফাতেহার সাথে আপনার জানা যেকোনো সূরা মেলালেই চলবে। ৩৩ বার সূরা আল কদর, ৩৩ বার ইখলাস ইত্যাদি উল্লেখ করা আছে। তবে সে নিয়মে পড়লেও অসুবিধার কারণ নেই।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ৪ রাকাত নামাজ ক্দরের রাতে আদায় করবে এবং উক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’য়ালা ওই ব্যক্তিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ করে দেবেন এবং বেহেশতের মধ্যে এক মনোমুগ্ধকর মহল তৈরি করে দেবেন।
অপর এক হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হযরত রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ক্দরের রজনীতে ৪ রাকাত নামাজ আদায় করবে এবং উহার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কদর ও সূরা ইখলাছ তিনবার করে পাঠ করবে, নামাজ শেষে সিজদায় গিয়ে নিম্নের দোয়াটি কিছু সময় পাঠ করে আল্লাহর দরবারে যা-ই প্রার্থনা করবে তিনি তাই কবুল করবেন এবং তার প্রতি অসংখ্য রহমত বর্ষিত করবেন।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত
পবিত্র কুরআন ও সহীহ-হাদীস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘শব-ই-বরাত’ নিয়ে এবং শব-ই-বরাতের হাদিসগুলোর বর্ণনা নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহ্দের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে- লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে তার কোনো অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন, নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গৃহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি এ (কুরআনকে) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জান, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম-কল্যাণময়’ (সূরা আল কদর : ১-৩)। এ রাতটি কোন মাসে?
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রমজান এমন মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে-’ (বাকারা : ১৮৫)। এ রাতটি রমজানের কোন তারিখে? রাসূলুল্লাহ সা: একটি রহস্যময় কারণে তারিখটি সুনির্দিষ্ট করেননি। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সা: বলেছেন, ‘কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোনো বেজোড় রাতে খোঁজ কর’। হজরত আবু বকর রা: ও হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এ একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো ইসলামি মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শব-ই-কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা: এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন।
এ রাতের আর একটি গুরুত্ব হল এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে। আর এ কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। এ জন্য কদরের আর একটি অর্থ হল- ভাগ্য। তাহলে লাইলাতুল কদরের অর্থ হয় ভাগ্য রজনি। যে মানুষ, যে সমাজ, যে জাতি, কুরআনকে বাস্তব জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করবে তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানীত হবে। এ রাতে নাযিলকৃত কুরআনকে যারা অবহেলা করবে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এ রাতেই মানব কল্যাণে আল্লাহ মানুষের জন্য চূড়ান্তু সিদ্ধান্ত ফেরেস্তাদের জানান। আল্লাহ বলেন- “এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়।” (সূরা দুখান : ৪)
মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রাইল আ:) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়, সে রাত পুরাপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার-ফজর উদয় হওয়া পর্যন্তু।’ (সূরা আল-কদর : ৪-৫)
লাইলাতুল কদরের ফজিলতগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
এ রাতটি হাজার মাস হতে উত্তম- কল্যাণময় (আল কুরআন)
এ রাতেই পবিত্র কুরআন নাযিল করা হয়েছে। (আল কুরআন)
এ রাতে ফেরেস্তা নাযিল হয় এবং আবেদ বান্দাহদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
ফজর পর্যন্ত এ রাতে পুরাপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার (আল কুরআন)
এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়। (আল কুরআন)
এ রাতে ইবাদতে মশগুল বান্দাদের জন্য অবতরণকৃত ফেরেশতারা দু’আ করেন। (হাদিস)
কিয়ামূল লাইল
‘কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হল রাত্রী জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুন। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে ‘তারা রাত্রী যাপন করে রবের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে।’(সূরা ফুরকান : ৬৪)
মুসনাদে আহমেদ গ্রন্থে হজরত ওবায়দা ইবনে সামেত বর্ণিত হাদিসে উদ্বৃত হয়েছে- ‘নবী করীম সা: বলেছেন- কদরের রাত রমজান মাসের শেষ দশ রাতে রয়েছে। যে ব্যক্তি উহার শুভফল লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, আল্লাহ তার আগের পিছনের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’
রাসূল সা: রমজানের শেষ দশদিন মসজিদে এ’তেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। কাজেই আমরা কোনো একটা বিশেষ রাতকে নির্দিষ্ট না করে হাদিস অনুযায়ী অন্তত রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য লাভের আশায় ইবাদতে মশগুল হই। রাসূল সা: বলেন- ‘যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত হতে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক আর কেউ বঞ্চিত হয় না।’ (মিশকাত)
সূরা আল কদরের অর্থসহ বাংলা উচ্চারণ
সূরা আল কদর (আরবি: سورة القدر) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের ৯৭ নম্বর সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ৫টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ১। আল কদর সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।
কদরের এক অর্থ মাহাত্ন্য ও সম্মান। এর মাহাত্ন্য ও সম্মানের কারণে একে ‘লায়লাতুল-কদর’ তথা মহিম্মান্বিত রাত বলা হয়। আবু বকর ওয়াররাক বলেন: এ রাত্রিকে লায়লাতুল-কদর বলার কারণ এই যে, আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোন সম্মান ও মূল্য মহিমান্বিত থাকে না, সে এ রাত্রিতে তওবা-এস্তেগফার ও এবাদতের মাধ্যমে সম্মানিতও হয়ে যায়।
Inna Anzalnahu fi Laylatul Qadr Bangla
লাইলাতুল কদর সূরা বাংলা অর্থসহ বাংলা উচ্চারণ:
سَلَـٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
১. إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ
ইন্না আনযালনাহু ফী লাইলাতিল কাদরি,
নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে
২. وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ
ওয়ামা আদরাকা মা লাইলাতুল কাদরি,
আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো?
৩. لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬
লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর,
কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
৪. تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيہَا بِإِذۡنِ رَبِّہِم مِّن كُلِّ أَمۡرٍ۬
তানাযযালুল মালাইকাতু ওয়াররূহ, ফিহা বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমরিন,
সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
৫. سورة القدر
সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফাজর।
শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।
Comments
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box. Thanks