ইতিকাফ কি?
আরবি ‘ইতিকাফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোনো স্থানে আটকে পড়া বা আবদ্ধ হয়ে থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় রমজান মাসের শেষ দশক বা অন্য কোনো দিন জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদতের নিয়তে মসজিদে বা ঘরে নামাজের স্থানে অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে। এর উদ্দেশ্য, মসজিদে বসে আল্লাহর আনুগত্য, সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভের আকাঙ্ক্ষা, সওয়াব অর্জনের প্রত্যাশা এবং লাইলাতুল কদর লাভের আশা করা।ইত্তিকাফ হল মুসলিমদের একটি ধর্মীয় চর্চা, যেখানে একজন মুসলিম তার নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী এক বা একাধিক দিন নিকটবর্তী মসজিদে দিনানিপাত করেন|[১] রমজান মাসে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষত রমজানের শেষ দশ দিনের জন্য। অনেক মসজিদেই মুসলমানরা রমযান মাসের শেষ দশ দিনে ইতিকাফে থাকে।
ইতিকাফ কেন?
ইতিকাফের স্বপক্ষে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- ‘ওয়া আনতুম আ’কিফু-না ফিল মাসা-জিদ’; তিলকা হুদু-দাল্লাহি ফালা-তাক্বরাবু-হা’। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১৮৭) অর্থাৎ আর যখন তোমরা মসজিদ ইতিকাফে বসো তখন স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা এর ধারে কাছেও যেয়ো না। ইতিকাফে বসার অর্থই হচ্ছে, রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে অবস্থান করা এবংএই দিনগুলোকে আল্লাহর যিকিরের জন্য নির্দিষ্ট করা। এই ইতিকাফে থাকা অবস্থায় নিজের মানবিক ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন (অজু, গোসল, মিসওয়াক, পায়খানা-পেশাব) পূর্ন করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় কিন্তু যৌন স্বাদ আস্বাদন করা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা একান্ত অপরিহার্য।
ইতিকাফ সর্ম্পকিত হাদিস সমূহ
লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান ও এর ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। জীবনের শেষ রমজান পর্যন্ত তিনি এ সময়কাল পালন করেছেন। মাহে রমজানের শেষ দশক এলে তিনি স্ত্রীদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন এবং ইবাদতে মশগুল হতেন। সারা রাত নিজেও জাগতেন এবং পরিজনকেও জাগিয়ে রাখতেন। ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময়সীমা এক রাত বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে। তবে ইতিকাফ দীর্ঘ সময় ধরে করা উত্তম, বিশেষত মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ অবস্থায় থাকায় ‘লাইলাতুল কদর’ বা হাজার মাসের শ্রেষ্ঠতম ভাগ্যের রজনী লাভের সৌভাগ্য হতে পারে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার জীবনে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করে গেছেন। (বুখারি, মুসলিম)। হযরত আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে যে পরিমাণ কষ্ট করতেন, এত কষ্ট অন্য সময় করতেন না।’ (মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, ‘শেষ দশক হাজির হলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা রাত জাগতেন, পরিবারের সবাইকে জাগাতেন। খুব কষ্ট করতেন এবং কোমরে কাপড় শক্ত করে বেঁধে নিতেন।’ (বুখারি, মুসলিম)। সুতরাং আখিরাতের চূড়ান্ত কল্যাণে গুনাহ মাফ ও জান্নাত লাভের জন্য ইতিকাফের প্রস্তুতি নেয়া প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের জন্য একান্ত আবশ্যক। ইতিকাফকালীন সময়ে পরিবারের সকল খরচাদি ও প্রাথমিক সমস্যা সমাধান করে আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে রমজানের শেষ দশ দিন সপে দেয়ার জন্য আমরা এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করি। আল্লাহ আমাদেরকে ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দি হাছিলের তাওফিক দান করুন।আমিন।
নবীজি ইতিকাফের এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, কখনো তা ছুটে গেলে ঈদের মাসে আদায় করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক (মসজিদে) ইতিকাফ করতেন। এ আমল তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত কায়েম ছিল। নবী করিম (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর বিবিগণও এ নিয়ম পালন করেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এক বছর ইতিকাফ করতে পারেননি, পরবর্তী বছর তিনি ২০ রাত ইতিকাফ করেন।’ (তিরমিজি) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) প্রতি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিফাক করতেন। তারপর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর ২০ দিন ইতিফাক করেন।’ (বুখারি) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নত এবং এর ফজিলত অপরিসীম। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করবে, তার জন্য দুই হজ ও দুই ওমরার সওয়াব রয়েছে।’ (বায়হাকি) তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এক দিনের ইতিকাফ করল, তার ও দোজখের মধ্যখানে আল্লাহ এমন তিনটি পরিখা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমেরও বেশি।’ (তিরমিজি)
যে ব্যক্তি ইবাদত মনে করে সওয়াবের নিয়তে ইতিকাফ করেন, তাঁর সব সগিরা গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। নবী করিম (সা.)-এর ফরমান, ‘ইতিকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকে আর ইতিকাফে লিপ্ত থাকার জন্য কোনো ব্যক্তি বাইরের কোনো নেক কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেও ওই নেক কাজগুলোর পূর্ণ নেকি সে লাভ করবে।’ (ইবনে মাজা) ‘ইতিকাফকারী মূলত গুনাহ থেকে দূরে থাকে এবং তাকে ইতিকাফের বিনিময়ে এত বেশি নেকি দেওয়া হবে, যেন সে সব নেকি অর্জনকারী।’ (ইবনে মাজা)
ইতিকাফের শুরু ও শেষ সময়
ইতিকাফের বিধিসম্মত সময় মাহে রমজানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু আগে থেকে শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তা শেষ হয়ে যায়।
ইতিকাফকারীর মসজিদে প্রবেশের ব্যাপারে জমহুর আলেম (চার ইমাম আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ি, আহমাদ) এর অভিমত হচ্ছে- ২১ রমযানের রাত শুরু হওয়ার আগে সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবেন। এ মতের পক্ষে তারা নিম্নোক্ত দলিল দেন:
১- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি রমযানের শেষ দশরাত্রি ইতিকাফ করতেন।[বুখারি ও মুসলিম]
এ হাদিসে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি রাত্রিতে ইতিকাফ করতেন; দিনে নয়। কারণ العشر শব্দটিاللياليশব্দের تمييز। আল্লাহ তাআলা বলেন: “দশরাত্রির শপথ” [সূরা আল-ফজর, আয়াত: ২]
শেষ দশরাত্রি ২১ তম রাত থেকে শুরু হয়।
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, ২১ তম রাত্রির সূর্যাস্তের পূর্বেই মসজিদে প্রবেশ করবেন।
২- তারা আরও বলেন: ইতিকাফকারী যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইতিকাফ করেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- লাইলাতুল ক্বদর প্রাপ্তি। রমযানের ২১তম রাত্রি শেষদশকের একটি বেজোড় রাত্রি; তাই এ রাতটি লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য এ রাতে ইতিকাফ করাটা বাঞ্ছনীয়।[এ কথাটি ইমাম সিন্দি রচিত নাসাঈর হাশিয়াতে রয়েছে; দেখুন: আল-মুগনি ৪/৪৮৯]
তবে সহিহ বুখারি (২০৪১) ও সহিহ মুসলিম (১১৭৩) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম যদি ইতিকাফ করতে চাইতেন তিনি ফজরের নামায পড়ে তাঁর ইতিকাফের স্থানে ঢুকে যেতেন।
এ হাদিসের বাহ্যিক অর্থের পক্ষে অভিমত দিয়ে বেশ কিছু সলফে সালেহীন বলেন: ফজরের নামাযের পর ইতিকাফস্থলে ঢুকতে হবে। এ মতটি সৌদি ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি গ্রহণ করেছেন (১০/৪১১) এবং বিন বাযও গ্রহণ করেছেন (১৫/৪৪২)।
তবে জমহুর আলেম এ দলিলের বিপক্ষে দুইটি জবাব দিয়ে থাকেন:
এক: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য ডোবার আগে থেকেই ইতিকাফ শুরু করেছেন। তবে তিনি ইতিকাফের জন্য মসজিদের সুনির্দিষ্ট স্থানে ফজরের নামাযের আগে প্রবেশ করেননি।
ইমাম নববী বলেন:
“যদি ইতিকাফ করতে চাইতেন তাহলে তিনি ফজরের নামায পড়ে ইতিকাফস্থলে ঢুকে যেতেন” এ হাদিসাংশ দিয়ে সেসব আলেম দলিল দেন যারা মনে করেন: দিনের শুরু থেকে ইতিকাফ শুরু হয়। আওযায়ি, ছাওরি, এক বর্ণনামতে লাইছ এ মতের প্রবক্তা। আর ইমাম মালেক, আবু হানিফা, শাফেয়ি ও আহমাদের মতে, যদি গোটা মাস অথবা দশদিন ইতিকাফ করতে চায় তাহলে সূর্যাস্তের পূর্বে ইতিকাফস্থলে প্রবেশ করবে। যারা এ মতের প্রবক্তা তারা উল্লেখিত হাদিসটির অর্থ করেন এভাবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ একাকিত্ব গ্রহণ করে ইতিকাফের বিশেষ স্থানে প্রবেশ করেছেন ফজরের নামাযের পর। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি ফজরের নামাযের পর ইতিকাফ শুরু করেছেন। বরং মাগরিবের আগেই তিনি ইতিকাফ শুরু করে মসজিদে অবস্থান নিয়েছেন; আর ফজরের নামাযের পর নির্জনতা গ্রহণ করেছেন। সমাপ্ত
দুই:
হাম্বলি মাযহাবের আলেম কাযী আবু ইয়ালা আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসের একটি জবাব দেন সেটি হচ্ছে- এ হাদিসকে এ অর্থে গ্রহণ করা যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২০ রমযান ফজরের নামাযের পরইতিকাফস্থলে প্রবেশ করতেন। সিন্দি বলেন: কিয়াসের মাধ্যমে এ জবাবটি জানা যায়। এ জবাবটি অধিক উত্তম এবং অধিক নির্ভরযোগ্য। সমাপ্ত
শাইখ উছাইমীনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল (ফাতাওয়াস সিয়াম পৃষ্ঠা-৫০১): কখন ইতিকাফ শুরু করা হবে?
জবাবে তিনি বলেন: জমহুর আলেমের মতে, ইতিকাফের শুরু হচ্ছে- ২১ রমযান রাত থেকে; ২১ রমযান ফজর থেকে নয়। যদিও কোন কোন আলেম বুখারি কর্তৃক সংকলিত আয়েশা (রাঃ) এর হাদিস “যখন ফজরের নামায পড়লেন তখন তিনি তাঁর ইতিকাফস্থলে প্রবেশ করলেন” দিয়ে দলিল দিয়ে বলেন: ২১ রমযান ফজর থেকে ইতিকাফ শুরু হবে। তবে জমহুর আলেম এর প্রত্যুত্তর দেন এভাবে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভোর থেকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা গ্রহণ করেন; তবে ইতিকাফের নিয়ত করেছেন রাতের প্রারম্ভ থেকে। কারণ শেষ দশক শুরু হয় ২০ তারিখ সূর্যাস্ত থেকে। সমাপ্ত
তিনি আরও বলেন (পৃষ্ঠা-৫০৩):
ইতিকাফকারী সূর্যাস্তের পর ২১ রমযান রাত থেকে মসজিদে প্রবেশ করবে। কারণ এটি হচ্ছে- শেষ দশকের শুরু। আর এটি আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ সে হাদিসের শব্দাবলি বিভিন্ন। সুতরাং সে হাদিসের যে শব্দ আভিধানিক অর্থের অধিক নিকটবর্তী সে শব্দটি গ্রহণ করতে হবে। সেটি ইমাম বুখারি কর্তৃক আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে (২০৪১) তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমযানে ইতিকাফ করতেন। যখন ফজরের নামায পড়া শেষ হত তখন তিনি যে স্থানে ইতিকাফ করেছেন সে স্থানে প্রবেশ করতেন।
তাঁর বাণী: “যখন ফজরের নামায পড়া শেষ হত তখন তিনি যে স্থানে ইতিকাফ করেছেন সে স্থানে প্রবেশ করতেন” এ বাণীর দাবী হচ্ছে- এ প্রবেশের পূর্বেই তিনি অবস্থান করেছেন। অর্থাৎ তিনি ইতিকাফের সুনির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশের পূর্বে মসজিদে অবস্থান নিয়েছেন। আর তাঁর বাণী: “তিনি ইতিকাফ করেছেন” এটি অতীত কালের ক্রিয়া। অতীত কালের ক্রিয়ার মূল রূপ হচ্ছে- এর আসল অর্থে ব্যবহার করা। সমাপ্ত
দুই: পক্ষান্তরে ইতিকাফ থেকে বের হওয়ার সময়:
রমযানের সর্বশেষ দিনের সূর্যাস্তের পর মসজিদ থেকে বের হতে হয়।
ইতিকাফের প্রকার
ইতিকাফ তিন প্রকার।
১. সুন্নত : শেষ দশকের ইতিকাফ।
২. নফল : যেকোনো সময় সেই ইতিকাফ করা যায়।
৩ ওয়াজিব : মানতের ইতিকাফ। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৮, বাহরুর রায়েক ২/৪২১, বাদায়েউস সানায়ে ২/১০৯)
(১) ওয়াজিব ইতিকাফ : ইতিকাফ করার মানত করলে ওই ইতিকাফ ওয়াজিব হয়। যেমন-আমার অমুক ইচ্ছা পূরণ হলে কিংবা অমুক কাজ সম্পন্ন হলে আমি ইতিকাফ করব। তদ্রূপ সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ করলে তার কাযা ওয়াজিব হয়। ওয়াজিব ইতিকাফের ক্ষেত্রে রোজা রাখা জরুরি। চাই ইতিকাফ রমজানে করা হোক কিংবা রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে। যতদিনের ইতিকাফ করার নিয়ত করবে তত দিন ও তত রাত ইতিকাফ করতে হবে। একাধিক দিনের ইতিকাফের মানত করলে ধারাবাহিক ইতিকাফ করা ওয়াজিব। মাঝখানে কোনো দিন বাদ পড়লে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না। নির্দিষ্ট কোনো সময় বা স্থানের মানত করে থাকলে ওই নির্দিষ্ট সময় ও ওই নির্দিষ্ট স্থানেই ইতিকাফ করতে হবে। ওয়াজিব ইতিকাফের নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরি।
(২) সুন্নাতে মুআক্কাদা: রমজানের শেষ ১০ দিন (২১তম রাত থেকে ২৯তম রাত পর্যন্ত) ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদা। ২০শে রমজান সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বেই ইতিকাফের স্থানে পৌঁছতে হবে। কয়েক মিনিট দেরি হলেও সুন্নাতে মুআক্কাদা আদায় হবে না, বরং ওই ইতিকাফ নফল হয়ে যাবে। এ ইতিকাফ সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। অর্থাত্ বড় শহরের মহল্লার যেকোনো মসজিদে এবং কোনো গ্রামের যেকোনো একটি মসজিদে এক ব্যক্তি ইতিকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর কোনো ব্যক্তি ইতিকাফ না করলে সকলের গুনাহ হবে। কোনো ব্যক্তিকে পারিশ্রমিক দিয়ে ইতিকাফে বসানো নাজায়েয। মসজিদে একাধিক লোক ইতিকাফে বসলে সকলেই সাওয়াব পাবে।
(৩) নফল ইতিকাফ: নফল ইতিকাফের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। এর জন্য রোজা রাখাও শর্ত নয়। নফল ইতিকাফ যেকোনো সময় যেকোনো মসজিদে (সেখানে পাঞ্জেগানা নামাজের জামাআত হোক বা না হোক) করা যায়। ইতিকাফের নিয়ত করে নামাজের জন্য অথবা যেকোনো প্রয়োজনে মসজিদে প্রবেশ করলে ইতিকাফের সাওয়াব পাওয়া যায়। নফল ইতিকাফকারী যতক্ষণ মসজিদে অবস্থান করে ততক্ষণ তার ইতিকাফ থাকে।
ইতিকাফ অবস্থায় করণীয়
ইতিকাফ অবস্থায় বেশি বেশি নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আযকার, দুআ-দরূদ করা এবং ইসলামি বইপুস্তক পড়া উচিত। দশ দিন দশ রাতের ২৪ ঘণ্টা রুটিন করে পুরো সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো উচিত।
(১) নামাজের মধ্যে বিশেষভাবে তাহিয়্যাতুল অযু, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, ইশরাকের নামাজ, চাশতের নামাজ, আউয়াবীন নামাজ এবং তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া উচিত। সম্ভব হলে সলাতুত তাসবীহ নামাজও পড়া উচিত।
(২) বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত। বিশেষভাবে ফযীলতপূর্ণ সূরাসমূহ অবশ্যই পড়া উচিত। যেমন- ফজরের নামাজের পর সূরা ইয়াসীন, জোহরের নামাজের পর সূরা ফাতাহ, আসরের নামাজের পর সূরা নাবা, মাগরিবের নামাজের পর সূরা ওয়াকিআ এবং ইশার নামাজের পর সূরা মুলক পড়া উচিত। তা ছাড়া সূরা কাহাফ, সূরা আর-রহমান, সূরা সাজদা, সূরা দুখান, সূরা মুযযাম্মিল, সূরা কদর, সূরা যিলযাল, সূরা আদিয়াত, সূরা তাকাসুর, সূরা কাফিরূন, সূরা নাসর, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি বেশি বেশি তিলাওয়াত করা উচিত।
(৩) যিকিরের মধ্যে বিশেষভাবে তিন তাসবীহ, বারো তাসবীহ, আয়াতে নূর এবং বেশি বেশি দরূদ শরীফ পাঠ করা উচিত।
(৪) ইসলামি বইপুস্তক পড়া উচিত।
ইতিকাফ অবস্থায় করনীয় ও বর্জনীয়
ইতিকাফ অবস্থায় জায়েয কাজকর্ম: খাওয়া-দাওয়া (মসজিদ যেন নোংরা না হয়), ঘুমানো, কাপড়-চোপড় বদল করা, আতর মাখা, তেল লাগানো, মাথা আছড়ানো, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা, নিজে বিবাহ করা কিংবা কাউকে বিবাহ করানো, রোগী দেখা বা রোগীকে ওষুধ লিখে দেওয়া (টাকার বিনিময়ে হলে মাকরুহ হবে), ইতিকাফকারী আরামের জন্য চাদর ঝুলিয়ে নিতে পারবে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র-বইপুস্তক ইত্যাদি মসজিদে রাখতে পারবে, মহিলারা ইতিকাফ অবস্থায় শিশুদেরকে দুধ পান করাতে পারবে।
ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ ও মাকরূহ কাজকর্ম: অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা, অশ্লীল গল্প-নভেল কিংবা পত্র-পত্রিকা পড়া বা শ্রবণ করা, প্রয়োজনাতিরিক্ত জিনিসপত্র মসজিদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা, মসজিদের বিদ্যুত্-গ্যাস-পানির অপচয় করা, মসজিদে বিড়ি-সিগারেট পান করা, বিনা প্রয়োজনে মোবাইলে গল্পগুজব করা, বিনা কারণে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা-চ্যাটিং করা ইত্যাদি।
পুরুষ ও মহিলাদের ইতিকাফ
পুরুষদের ইতিকাফ
ইতিকাফকারী পুরুষ ২০ রমজান আসরের নামাজের পর সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছাবেন এবং কোণে একটি ঘরের মতো পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে অবস্থান নেবেন; এমনভাবে যেন প্রয়োজনে জামাতের সময় পর্দা খুলে মুসল্লিদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা করা যায়। এ স্থানে পানাহার ও শয়ন করবেন এবং বিনা প্রয়োজনে এখান থেকে বের হবেন না। তবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বা ফরজ গোসল প্রভৃতি কাজে অথবা শরিয়তের প্রয়োজনে যেমন জুমার নামাজ প্রভৃতির জন্য বের হওয়া জায়েজ। জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগের জন্য পুরুষদের মসজিদে এবং নারীদের জন্য গৃহে অবস্থান করাই ইতিকাফ। মহিলাদের ইতিকাফ
মেয়েদের ইতিকাফের নিয়ম বা নারীদের ইতিকাফ
মহিলাদের ইতিকাফ : মহিলারা বাড়ির যে অংশে নামাজ আদায় করে থাকেন তারা সেখানে ইতিকাফ করবেন। অতি প্রয়োজন ব্যতীত নামাজের ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে পারবেন না। ঘরে নামাজের জন্য কোনো স্থান নির্দিষ্ট না থাকলে কোনো একটি স্থান নির্দিষ্ট করে সেখানে ইতিকাফ করবেন। মহিলাদের ইতিকাফের ক্ষেত্রে অন্যান্য মাসায়েল পুরুষদের ইতিকাফের মতোই।স্ত্রীলোকের মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরুহ। ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেখানেই ইতিকাফ করবেন। বাড়ির নির্দিষ্ট স্থান না থাকলে যেকোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে ইতিকাফ করবেন এবং ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবেন না।
Comments
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box. Thanks